গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে কী বোঝ? (Global warming).

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে কী বোঝ? (Global warming).

সূর্যের আলোকরশ্মি থেকে সৃষ্ট তাপশক্তির বেশ খানিকটা অংশ মহাশূন্যে না ফিরে গ্রিনহাউস গ্যাস আস্তরণ দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীপৃষ্ঠে ফিরে আসে, যার ফলে পৃথিবীও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, সেই ঘটনাকে ‘বিশ্ব উয়ায়ন‘ বা ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং‘ বলে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টিতে মানুষের ভূমিকা কি?

আধুনিক মানুষ তার জীবন যাত্রার মানকে উন্নত ও আরামপ্রদ করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে। কিন্তু মানুষের চিন্তা লব্ধ ফসলগুলির মধ্যে এমন কিছু আছে, যেগুলি আপাত সুখকর মনে হলেও মানুষের স্থায়িত্বকালকে বিপন্ন করে তুলছে। কারণ মানুষের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গ্রীণ হাউস নির্গত হচ্ছে, যাদের দ্বারা বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে।

পৃথিবীর এই  উষ্ণ হওয়ার পিছনে যে সমস্তত মানবিক কার্যাবলী দায়ী সেগুলি হল:

শিল্পায়ন, নগরায়ন, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির দহন,  পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, মহাকাশ গবেষণা ও অভিযান ইত্যাদি।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টিতে কতগুলি গ্যাসের ভূমিকা:

মানুষের উপরিলিখিত  কার্যাবলীর  ফলে  বিভিন্ন ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় এবং সেগুলি গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের  ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নিম্নে গ্রীণ হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে অথবা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে এই গ্যাসগুলির ভূমিকা আলোচনা করা হলো:

কার্বন ডাই অক্সাইড:

গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মুখ্য ভূমিকা পালন করে। গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের অবদান প্রায় ৫০%-৬০%। শিল্প বিপ্লবের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, যথেচ্ছ হারিয়ে বৃক্ষছেদন ও অরণ্যবিনাশ, যানবাহন ব্যবহারের বৈপ্লবিক উন্নতি এবং জ্বালানি হিসাবে কাষ্ঠ ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলস্বরূপ গ্রীন হাউস ইফেক্ট এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নে মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ক্লোরোফ্লোরো কার্বন:

ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFC) একটি ক্লোরিণ ঘটিত গ্যাসীয় পদার্থ, যা প্লাস্টিক, রঙ, রেফ্রিজারেটর, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদি নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি  থেকে প্রচুর পরিমাণে নির্গত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশছে। গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে এই গ্যাসের অবদান প্রায় ১৫%-২৫% এবং ইহা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় প্রায় ১০,০০০ গুণ বেশি সক্রিয়। কারণ এই গ্যাসটি আলোক বর্ণালীর অবলোহিত বিকিরণ শোষণ করার ক্ষমতা রাখে। মনুষ্যকৃত বিভিন্ন কার্যাবলীর প্রভাবে প্রতিবছর বায়ুমন্ডলে এই গ্যাসের পরিমাণ ৪-৬ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গ্রীন হাউস এফেক্ট এবং মোবাইল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টির জন্য দায়ী।

মিথেন:

গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের থেকে মিথেন অন্তত ২৫ গুণ বেশি সক্রিয়। প্রধানত ধানক্ষেত, গবাদি পশুর মলমূত্র, কয়লা খনি, প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপ, কাঠের দহন ইত্যাদি হল মিথেনের প্রধান কয়েকটি উৎস। বায়ুমন্ডলে এই গ্যাস প্রাকৃতিক উপায়েই বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অত্যধিক যুক্ত হওয়ায় মিথেন বিনাশের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় ১.১% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গ্রীন হাউজ এফেক্ট বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করছে।

নাইট্রাস অক্সাইড:

গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে নাইট্রাস অক্সাইডের অবদান প্রায় ৫% এবং এই গ্যাসটি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের থেকে প্রায় ২৫০ গুণ বেশি সক্রিয়। প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন, জমিতে নাইট্রোজেন যুক্ত সার প্রয়োগ, মাটিতে জীবাণুর ক্রিয়া, অরণ্য বিনাশ, দাবানল ইত্যাদি হল নাইট্রাস অক্সাইডের প্রধান উৎস। বায়ুমন্ডলে গ্যাসের পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় ৩% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসের অনুগুলি CFC-এর তুলনায় অধিক স্থায়ী হলেও ঘনত্ব কম হওয়ায় গ্রীন হাউস এফেক্ট ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টিতে এর ভূমিকা অপেক্ষাকৃত কম।

ওজোন:

গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে ওজোন গ্যাসের ভূমিকা প্রায় ৫%। ওজোন গ্যাস সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মিকে শোষণ করলেও ওজোনস্তর সূর্য রশ্মিকে পৃথিবীতে আপতিত হতে দেয়, কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে অবলোহিত রশ্মিকে মহাশূন্যে বিকিরিত হতে বাধা দেয়। ফলে গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টি হয় এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টি হয়।

জলীয় বাষ্প:

গ্রীন হাউস এফেক্ট সৃষ্টিতে জলীয় বাষ্পের ভূমিকা খুবই জটিল। প্রতিনিয়ত অতি বিপুল পরিমাণ জলীয়বাষ্প সমুদ্র ও স্থলভাগের বিভিন্ন জলাশয় থেকে বায়ুমণ্ডলে মিশছে। জলের বাষ্পীভবন ঘটার সময় ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পায়।আবার জলীয়বাষ্প মেঘের সৃষ্টি করলে সূর্যরশ্মি অবাধে ভূপৃষ্ঠে পৌছাতে পারেন। এছাড়া এই জলীয়বাষ্প নিজেই অবলোহিত রশ্মি শোষণ করে উত্তপ্ত হয় এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বাকাশে তাপমাত্রার স্বাভাবিক বিকিরণে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় তথা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টি হয়।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলাফল:

বিশ্ব উন্নায়নের ফলে দিনে এই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৩.৫°C বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে জীবজগতে ও বাস্তুতন্ত্রে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর দ্বারা যে প্রধান সমস্যাগুলি সৃষ্টি হবে, সেগুলি হল—

সমুদ্রের জলের উচ্চতা বৃদ্ধি:

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গ্রিনল্যান্ডের বরফের চাদর, দক্ষিণ মেরুর হিমবাহ ও সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের বরফগুলি গলে যাবে। এর ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ও সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন বন্দর, শহর এবং অনেক ছেটো ছোটো দ্বীপপুঞ্জ জলের তলায় চলে যাবে।

জলবায়ুর পরিবর্তন:

বিশ্ব উন্নায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। ভবিষ্যতে সাইক্লোন, বন্যা, খরা, সুনামি, এল নিনো জাতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পাবে।

জল সংকট:

বিশ্ব উন্নায়নের ফলে পৃথিবীর উয় অঞ্চলে জলের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং কিছুকিছু জায়গায় তীব্র জল সংকট তৈরি হবে।

হিমবাহের পশ্চাদপসরণ:

গ্লোবাল ওয়ার্মিং -এর জন্য হিমালয়ের অমরনাথ গুহার বরফের শিবলিঙ্গের উচ্চতা কমেছে। এ ছাড়া হিমবাহের পশ্চাদপসরণ (glacial retreat) ঘটছে ও হিমরেখার উচ্চতা বাড়ছে।

জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হওয়া:

বিশ্ব উন্নায়নের ফলে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ম্যানগ্রোভ ইত্যাদি ধ্বংস হচ্ছে এবং দাবানলের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মরুভূমির প্রসার:

বিশ্ব উন্নায়নের ফলে দিনে দিনে মরুভূমির উন্নতা আরও বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি আরও শুষ্ক হবে, ফলে মরুভূমির বিস্তৃতি আরও বাড়বে।

বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন:

বিশ্ব উয়ায়নের ফলে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগুলিতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। প্রাণীরা বাঁচার তাগিদে এক স্থান থেকে সুবিধাজনক অন্য স্থানের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু উদ্ভিদজগৎ নিজেদের মানিয়ে নিতে না পেরে ধ্বংস হবে। ফলে বহু জীব বিপন্ন হবে ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

Sukanta Das, the founder of Protijogita.in, holds a Master’s degree (M.A) in Political Science. With a deep passion for education and a strong commitment to student success, he created this platform to support learners preparing for various competitive exams and academic pursuits. Combining his academic background with real-world insights, Sukanta curates high-quality study materials, current affairs updates, and mock tests — making Protijogita.in a trusted resource for students across India. His mission is to make learning simple, accessible, and effective for all.

Post Comment