ভারতের বিচারব্যবস্থায় কলেজিয়াম পদ্ধতি (Collegium System of Judiciary in India).

ভারতের বিচারব্যবস্থায় কলেজিয়াম পদ্ধতি

ভারতের বিচারব্যবস্থায় কলেজিয়াম পদ্ধতি (Collegium System of Judiciary in India).

Table of Contents

ভূমিকা:

ভারতের বিচারব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা। বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা — কলেজিয়াম পদ্ধতি (Collegium System)। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বিচারপতিরা নিজেরাই বিচারপতি নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার একটি মূলভিত্তি।

কলেজিয়াম পদ্ধতি কী?

কলেজিয়াম পদ্ধতি (Collegium System) হল এমন একটি ব্যবস্থা যার অধীনে ভারতের প্রধান বিচারপতি (Chief Justice of India) এবং সুপ্রিম কোর্টের চারজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মিলে একটি ফোরাম গঠন করেন।
এই ফোরামটি বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

কলেজিয়াম পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হল — বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং সরকার বা নির্বাহীর প্রভাবমুক্তভাবে বিচারপতি নিয়োগ করা।

সংবিধানের নির্দেশ: বিচারপতি নিয়োগ সম্পর্কিত ধারা

ধারা ১২৪ – সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ

ভারতের সংবিধানের ১২৪(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, এবং এই নিয়োগ রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে করবেন।”

অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগের আগে প্রধান বিচারপতি ও সংশ্লিষ্ট বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

ধারা ২১৭ – হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ

এখানে বলা হয়েছে —

“রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও রাজ্যের গভর্নরের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করবেন।”

অর্থাৎ, হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগেও প্রধান বিচারপতির মতামত অপরিহার্য।

কলেজিয়াম পদ্ধতির উদ্ভব: তিন বিচারক মামলা (Three Judges Cases)

প্রথম বিচারক মামলা (S.P. Gupta Case, 1981)

এটি “First Judges Case” নামে পরিচিত। এই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে —
বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির পরামর্শই চূড়ান্ত হবে, প্রধান বিচারপতির মতামত বাধ্যতামূলক নয়।
ফলে, এই সময়ে নির্বাহী বিভাগ বিচারপতি নিয়োগে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় বিচারক মামলা (Advocates-on-Record Association vs Union of India, 1993)

এই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রথম রায় উল্টে দিয়ে ঘোষণা করে যে —
বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতির মতামতই প্রধান ও প্রাধান্যপূর্ণ হবে।
এটি ছিল কলেজিয়াম পদ্ধতির সূচনা।
এই রায়ে বলা হয়, “বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের সমান ভূমিকা থাকা উচিত নয়।”

তৃতীয় বিচারক মামলা (Presidential Reference, 1998)

রাষ্ট্রপতি কে. আর. নারায়ণন একটি রেফারেন্স পাঠান সুপ্রিম কোর্টে — জানতে চান “পরামর্শ” শব্দের প্রকৃত অর্থ কী।
নয় বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয় যে —
প্রধান বিচারপতি এককভাবে নয়, বরং চারজন সিনিয়র বিচারকের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই রায়ের পর থেকেই কলেজিয়াম পদ্ধতির বর্তমান রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়।

কলেজিয়াম গঠন ও কার্যপ্রণালী:

সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়াম

সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম গঠিত হয়:

  • ভারতের প্রধান বিচারপতি (CJI)
  • ও চারজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি নিয়ে।

এই প্যানেল হাইকোর্টের বিচারকদের সুপ্রিম কোর্টে উন্নীত করা, অথবা বিচারকদের স্থানান্তর বা পদোন্নতি সংক্রান্ত সুপারিশ করে।

হাইকোর্ট কলেজিয়াম

প্রত্যেক হাইকোর্টের কলেজিয়ামে থাকে:

  • হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি
  • ও সেই আদালতের দুইজন জ্যেষ্ঠ বিচারক।

এরা বিচারক নিয়োগের জন্য সুপারিশ তৈরি করে, যা পরে সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়ামে পাঠানো হয়।

কলেজিয়াম পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা

১. স্বচ্ছতার অভাব

কলেজিয়াম পদ্ধতির অন্যতম বড় সমালোচনা হল — এর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ গোপন।
সাধারণ মানুষ বা সংবাদমাধ্যম জানে না কে, কেন, এবং কীভাবে বিচারক হিসেবে নির্বাচিত হচ্ছেন।

২. জবাবদিহিতার অভাব

বিচারপতিদের নিজেরাই বিচারক নিয়োগ করলে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোনও ভূমিকা থাকে না
ফলে এটি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

৩. বিচার বিভাগের আধিপত্য

অনেকে মনে করেন, এই পদ্ধতিতে বিচার বিভাগ নিজেই নিজের জন্য বিচারপতি বেছে নিচ্ছে, যা এক ধরনের “জুডিশিয়াল ওলিগার্কি” তৈরি করছে।

কলেজিয়ামের বিকল্প প্রস্তাব: এনজেসি (National Judicial Appointments Commission – NJAC)

এনজেসি গঠনের প্রস্তাব

২০০৩ সালে এনডিএ সরকার সংবিধান (৯৮তম সংশোধনী) বিল পেশ করে, যাতে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কমিশন (NJC) গঠনের প্রস্তাব ছিল।
২০১৪ সালে NJAC Act পাস হয়, যা কলেজিয়াম পদ্ধতির পরিবর্তে একটি স্বচ্ছ কমিশন প্রবর্তনের চেষ্টা করে।

এনজেসি গঠনের প্রস্তাবিত কাঠামো

  • ভারতের প্রধান বিচারপতি
  • দুইজন সিনিয়র বিচারপতি
  • কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী
  • ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত একজন বিশিষ্ট নাগরিক

তবে ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট এনজেসি আইন বাতিল করে দিয়ে বলে —

“এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী।”

ফলে কলেজিয়াম পদ্ধতিই বর্তমানে কার্যকর।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা (Guidelines of Collegium System):

সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯৮ সালের রায়ে কিছু নির্দেশিকা নির্ধারণ করা হয়েছিলঃ

  1. সিজেআই এককভাবে নয়, চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারকের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
  2. প্রতিটি সুপারিশ লিখিতভাবে রেকর্ড করতে হবে।
  3. হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে উন্নীত করার ক্ষেত্রে, দুইজন জ্যেষ্ঠ বিচারকের পরামর্শ প্রয়োজন।
  4. সরকারের জন্য কলেজিয়ামের সুপারিশ বাধ্যতামূলক নয়, তবে অস্বীকারের জন্য যৌক্তিক কারণ দিতে হবে।
  5. বিচারপতি স্থানান্তর বা পদোন্নতির সিদ্ধান্ত আদালতের বিচারাধীন পর্যালোচনার যোগ্য

উপসংহার:

কলেজিয়াম পদ্ধতি ভারতের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তবে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলমান।
বর্তমানে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নে এই পদ্ধতির সংস্কার অপরিহার্য।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা— এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ।

Protijogita.in শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এম.এ করেছি এবং শিক্ষকতা করি। এই ওয়েবসাইটে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রশ্নোত্তর, মক টেস্ট, এবং দরকারি অধ্যয়ন সামগ্রী প্রদান করা হয়।

Post Comment

error: Content is protected !!