রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles of State Policy – DPSP).
সংবিধানের চতুর্থ অংশে (Part IV), ৩৬–৫১ নং ধারা-এ রাষ্ট্রের নীতিনির্দেশক তত্ত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এদের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা এবং ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা।
ড. বি. আর. আম্বেদকর DPSP–কে “সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য” বলেছেন। জওহরলাল নেহেরু এগুলিকে “জাতির সামাজিক দর্শনের প্রতিফলন” বলে উল্লেখ করেছিলেন।
DPSP-এর বৈশিষ্ট্য (Features of DPSP):
১. অ-ন্যায়বিচারযোগ্য (Non-Justiciable):
এই নীতিগুলি আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করানো যায় না। রাষ্ট্র এগুলো মানতে বাধ্য হলেও নাগরিক সরাসরি মামলা করতে পারে না।
২. নৈতিক ও রাজনৈতিক নির্দেশনা:
এগুলো রাষ্ট্রকে শাসনকার্যে পথ দেখায়—একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতি প্রদান করে।
৩. জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State) গঠন:
DPSP–র মাধ্যমে সংবিধান রচয়িতারা ভারতকে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
৪. ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের ‘Instrument of Instructions’ দ্বারা প্রভাবিত:
যেখানে গভর্নর ও গভর্নর-জেনারেলকে শাসনব্যবস্থার মৌলিক দিকনির্দেশ দেওয়া হত।
৫. সংবিধানের অংশ IV এর মূল দর্শন:
মৌলিক অধিকার ও নীতিনির্দেশক তত্ত্ব পরস্পর পরিপূরক—দুই মিলেই ভারতের রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ।
৬. রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের ওপর প্রযোজ্য:
কেন্দ্র, রাজ্য ও সংবিধানের ১২ নং ধারায় উল্লেখিত ‘রাষ্ট্র’ সংজ্ঞার আওতায় থাকা সকল সংস্থা—অর্থাৎ স্থানীয় সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, আধা-সরকারি সংস্থা।
৭. সামাজিক–অর্থনৈতিক বিপ্লবের ভিত্তি:
দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, শিক্ষার বিস্তার—এই লক্ষ্যগুলি DPSP-এর মূল ভিত্তি।
DPSP-এর শ্রেণীবিভাগ (Classification):
DPSP–কে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—
- সমাজতান্ত্রিক নীতি (Socialistic Principles).
- গান্ধীবাদী নীতি (Gandhian Principles).
- উদার-বৌদ্ধিক নীতি (Liberal–Intellectual Principles).
নিচে প্রতিটি বিভাগ খুব বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো—
সমাজতান্ত্রিক নীতি (Socialistic Principles):
উদ্দেশ্য: অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সমাজে বৈষম্য দূর করা, শ্রমিক ও দরিদ্রদের উন্নয়ন।
৩৮ নং ধারা – সামাজিক শৃঙ্খলা ও বৈষম্য হ্রাস:
রাষ্ট্রের দায়িত্ব—
- ন্যায়নিষ্ঠ সামাজিক শৃঙ্খলা গঠন।
- জনগণের কল্যাণ বৃদ্ধি।
- আয়, সুযোগ, অবস্থা ও সুবিধার ক্ষেত্রে অসমতা কমানো।
- ৮৬তম সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধান আরও জোর দিয়েছে সামাজিক ন্যায়ের ওপর।
৩৯ নং ধারা – অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা:
রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে—
- সকল নাগরিকের জীবিকা নির্বাহের উপযুক্ত উপায়।
- সমাজের সম্পদের ন্যায্য বণ্টন।
- সম্পদের অতিরিক্ত ঘনত্ব রোধ।
- সমান কাজের জন্য সমান বেতন।
- শিশুদের শোষণ ও জোরপূর্বক শ্রম রোধ।
- শিশুদের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য সুযোগ।
৩৯ (ক) নং ধারা – আইনি সহায়তা ও সমান ন্যায়বিচার:
দরিদ্র, দুর্বল ও বঞ্চিত নাগরিকদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান।
৪১ নং ধারা – কাজ, শিক্ষা ও জনসাহায্যের অধিকার:
রাষ্ট্র বিশেষ পরিস্থিতিতে (বেকারত্ব, বার্ধক্য, অসুস্থতা, প্রতিবন্ধিতা) নাগরিকদের—
- কাজের সুযোগ।
- শিক্ষার সুযোগ।
- জনসাহায্য প্রদান করবে।
৪২ নং ধারা – মানবিক শ্রমপরিবেশ ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা:
নারী শ্রমিকদের—
- মাতৃত্বকালীন ছুটি।
- স্বাস্থ্যসুরক্ষা।
- মানবিক কর্মপরিবেশ।
৪৩ নং ধারা – উপযুক্ত মজুরি ও জীবনযাত্রার মান:
- জীবনযাত্রার উপযুক্ত মজুরি।
- জীবনমান উন্নয়ন।
- কুটির শিল্পের প্রসার।
৪৩ (ক) নং ধারা – শিল্পে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ:
শ্রমিকরা শিল্পের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৪৭ নং ধারা – জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন:
- পুষ্টির মান বৃদ্ধি।
- জনস্বাস্থ্যের উন্নতি।
- নেশাদ্রব্য ও ক্ষতিকর পানীয়র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ।
গান্ধীবাদী নীতি (Gandhian Principles):
এগুলো গান্ধীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবধারার প্রতিফলন।
মূল ভাবনা—গ্রামস্বরাজ, স্বনির্ভরতা, কুটির শিল্প, দুর্বল শ্রেণির upliftment, নৈতিক মূল্যবোধ।
৪০ নং ধারা – গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন:
- স্থানীয় স্বশাসন (Local Self Government)।
- গ্রাম পঞ্চায়েতকে ‘স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট’ হিসেবে গড়ে তোলা।
- এটি গান্ধীর গ্রামস্বরাজ ধারণার ভিত্তি।
৪৩ নং ধারা – কুটির শিল্পের প্রসার:
গ্রামীণ এলাকায়—
- স্বতন্ত্র উদ্যোগ
- সমবায় ভিত্তিক কুটির শিল্প
- গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন
৪৬ নং ধারা – দুর্বল শ্রেণির উন্নয়ন:
- SC, ST ও অন্যান্য দুর্বল শ্রেণীর শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক উন্নতি।
- সামাজিক অন্যায় ও শোষণ থেকে সুরক্ষা।
- সামাজিক ন্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
৪৭ নং ধারা – নেশাদ্রব্য নিষিদ্ধ:
রাষ্ট্র ক্ষতিকর পানীয় ও মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে।
৪৮ নং ধারা – বৈজ্ঞানিক কৃষি ও পশুপালন; গরু হত্যা নিষিদ্ধ:
- কৃষির আধুনিকীকরণ
- পশুপালনের উন্নতি
- গাভী ও গবাদি পশুর সংরক্ষণ
- এটি ভারতীয় সমাজের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের প্রতিফলন।
উদার-বৌদ্ধিক নীতি (Liberal–Intellectual Principles):
উদ্দেশ্য—বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, মানবিক মূল্যবোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি।
৪৪ নং ধারা – অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (Uniform Civil Code):
- দেশে সকলের জন্য সমান দেওয়ানি আইন।
- ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিগত আইনের বদলে একক আইনি ব্যবস্থা।
৪৫ নং ধারা – শিশুদের শিক্ষা ও যত্ন:
- ৬ বছরের নিচে শিশুদের প্রাথমিক যত্ন
- প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা
(২০০২ সালের ৮৬তম সংশোধনীতে ৬–১৪ বছরের শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার করা হয়।)
৪৮ নং ধারা – বৈজ্ঞানিক কৃষি ও পশুপালন:
- আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি।
- পশুপালনের উন্নয়ন।
- পরিবেশ সুরক্ষা।
৪৮(ক) নং ধারা – পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ:
রাষ্ট্র বাধ্য—
- পরিবেশ রক্ষা।
- বন সংরক্ষণ।
- বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ। ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত।
৪৯ নং ধারা – ঐতিহাসিক স্থান ও স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ:
- ঐতিহাসিক, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের স্থান সংরক্ষণ।
- প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষা।
৫০ নং ধারা – বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা:
- বিচার বিভাগকে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে পৃথক করা।
- ‘Separation of Judiciary from Executive’.
৫১ নং ধারা – আন্তর্জাতিক শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ:
রাষ্ট্র—
- আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা।
- জাতিসংঘের সনদের প্রতি আনুগত্য।
- আন্তর্জাতিক বিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি।
- মানবাধিকারের উন্নয়ন।
- আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান রাখবে।
উপসংহার (Conclusion):
সংবিধানের চতুর্থ অংশের রাষ্ট্রের নীতিনির্দেশক তত্ত্ব ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে। এগুলি আদালতে বলবৎযোগ্য না হলেও রাষ্ট্রকে একটি জনকল্যাণমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিশা দেয়। সমাজতান্ত্রিক নীতি সামাজিক–অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, গান্ধীবাদী নীতি গ্রামস্বরাজ ও দুর্বল শ্রেণির upliftment–কে গুরুত্ব দেয়, আর উদার–বৌদ্ধিক নীতি বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক শান্তির মূল্যবোধকে সুসংহত করে।
মৌলিক অধিকার ব্যক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, আর নির্দেশমূলক নীতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করে—এই দুইয়ের সমন্বয়েই ভারতীয় সংবিধানের পূর্ণতা ও মানবিক আদর্শ স্পষ্ট হয়। তাই DPSP শুধু রাষ্ট্রের নীতি নয়, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগঠনের নৈতিক কম্পাস হিসেবে বিবেচিত।



Post Comment