রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles of State Policy – DPSP).

WhatsApp Image 2025 12 08 at 12.11.56 PM

রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles of State Policy – DPSP).

সংবিধানের চতুর্থ অংশে (Part IV), ৩৬–৫১ নং ধারা-এ রাষ্ট্রের নীতিনির্দেশক তত্ত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এদের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা এবং ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা।

ড. বি. আর. আম্বেদকর DPSP–কে “সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য” বলেছেন। জওহরলাল নেহেরু এগুলিকে “জাতির সামাজিক দর্শনের প্রতিফলন” বলে উল্লেখ করেছিলেন।

Table of Contents

DPSP-এর বৈশিষ্ট্য (Features of DPSP):

১. অ-ন্যায়বিচারযোগ্য (Non-Justiciable):
এই নীতিগুলি আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করানো যায় না। রাষ্ট্র এগুলো মানতে বাধ্য হলেও নাগরিক সরাসরি মামলা করতে পারে না।

২. নৈতিক ও রাজনৈতিক নির্দেশনা:
এগুলো রাষ্ট্রকে শাসনকার্যে পথ দেখায়—একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতি প্রদান করে।

৩. জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State) গঠন:
DPSP–র মাধ্যমে সংবিধান রচয়িতারা ভারতকে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।

৪. ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের ‘Instrument of Instructions’ দ্বারা প্রভাবিত:
যেখানে গভর্নর ও গভর্নর-জেনারেলকে শাসনব্যবস্থার মৌলিক দিকনির্দেশ দেওয়া হত।

৫. সংবিধানের অংশ IV এর মূল দর্শন:
মৌলিক অধিকার ও নীতিনির্দেশক তত্ত্ব পরস্পর পরিপূরক—দুই মিলেই ভারতের রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ।

৬. রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের ওপর প্রযোজ্য:
কেন্দ্র, রাজ্য ও সংবিধানের ১২ নং ধারায় উল্লেখিত ‘রাষ্ট্র’ সংজ্ঞার আওতায় থাকা সকল সংস্থা—অর্থাৎ স্থানীয় সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, আধা-সরকারি সংস্থা।

৭. সামাজিক–অর্থনৈতিক বিপ্লবের ভিত্তি:
দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, শিক্ষার বিস্তার—এই লক্ষ্যগুলি DPSP-এর মূল ভিত্তি।

DPSP-এর শ্রেণীবিভাগ (Classification):

DPSP–কে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—

  • সমাজতান্ত্রিক নীতি (Socialistic Principles).
  • গান্ধীবাদী নীতি (Gandhian Principles).
  • উদার-বৌদ্ধিক নীতি (Liberal–Intellectual Principles).

নিচে প্রতিটি বিভাগ খুব বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো—

সমাজতান্ত্রিক নীতি (Socialistic Principles):

উদ্দেশ্য: অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সমাজে বৈষম্য দূর করা, শ্রমিক ও দরিদ্রদের উন্নয়ন।

৩৮ নং ধারা – সামাজিক শৃঙ্খলা ও বৈষম্য হ্রাস:

রাষ্ট্রের দায়িত্ব—

  • ন্যায়নিষ্ঠ সামাজিক শৃঙ্খলা গঠন।
  • জনগণের কল্যাণ বৃদ্ধি।
  • আয়, সুযোগ, অবস্থা ও সুবিধার ক্ষেত্রে অসমতা কমানো।
  • ৮৬তম সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধান আরও জোর দিয়েছে সামাজিক ন্যায়ের ওপর।

৩৯ নং ধারা – অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা:

রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে—

  • সকল নাগরিকের জীবিকা নির্বাহের উপযুক্ত উপায়
  • সমাজের সম্পদের ন্যায্য বণ্টন
  • সম্পদের অতিরিক্ত ঘনত্ব রোধ
  • সমান কাজের জন্য সমান বেতন
  • শিশুদের শোষণ ও জোরপূর্বক শ্রম রোধ।
  • শিশুদের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য সুযোগ।

৩৯ (ক) নং ধারা – আইনি সহায়তা ও সমান ন্যায়বিচার:

দরিদ্র, দুর্বল ও বঞ্চিত নাগরিকদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান।

৪১ নং ধারা – কাজ, শিক্ষা ও জনসাহায্যের অধিকার:

রাষ্ট্র বিশেষ পরিস্থিতিতে (বেকারত্ব, বার্ধক্য, অসুস্থতা, প্রতিবন্ধিতা) নাগরিকদের—

  • কাজের সুযোগ।
  • শিক্ষার সুযোগ।
  • জনসাহায্য প্রদান করবে।

৪২ নং ধারা – মানবিক শ্রমপরিবেশ ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা:

নারী শ্রমিকদের—

  • মাতৃত্বকালীন ছুটি।
  • স্বাস্থ্যসুরক্ষা।
  • মানবিক কর্মপরিবেশ।

৪৩ নং ধারা – উপযুক্ত মজুরি ও জীবনযাত্রার মান:

  • জীবনযাত্রার উপযুক্ত মজুরি।
  • জীবনমান উন্নয়ন।
  • কুটির শিল্পের প্রসার।

৪৩ (ক) নং ধারা – শিল্পে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ:

শ্রমিকরা শিল্পের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।

৪৭ নং ধারা – জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন:

  • পুষ্টির মান বৃদ্ধি।
  • জনস্বাস্থ্যের উন্নতি।
  • নেশাদ্রব্য ও ক্ষতিকর পানীয়র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ।

গান্ধীবাদী নীতি (Gandhian Principles):

এগুলো গান্ধীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবধারার প্রতিফলন।
মূল ভাবনা—গ্রামস্বরাজ, স্বনির্ভরতা, কুটির শিল্প, দুর্বল শ্রেণির upliftment, নৈতিক মূল্যবোধ

৪০ নং ধারা – গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন:

  • স্থানীয় স্বশাসন (Local Self Government)।
  • গ্রাম পঞ্চায়েতকে ‘স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট’ হিসেবে গড়ে তোলা।
    • এটি গান্ধীর গ্রামস্বরাজ ধারণার ভিত্তি।

৪৩ নং ধারা – কুটির শিল্পের প্রসার:

গ্রামীণ এলাকায়—

  • স্বতন্ত্র উদ্যোগ
  • সমবায় ভিত্তিক কুটির শিল্প
    • গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন

৪৬ নং ধারা – দুর্বল শ্রেণির উন্নয়ন:

  • SC, ST ও অন্যান্য দুর্বল শ্রেণীর শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক উন্নতি।
  • সামাজিক অন্যায় ও শোষণ থেকে সুরক্ষা।
    • সামাজিক ন্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

৪৭ নং ধারা – নেশাদ্রব্য নিষিদ্ধ:

রাষ্ট্র ক্ষতিকর পানীয় ও মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে।

৪৮ নং ধারা – বৈজ্ঞানিক কৃষি ও পশুপালন; গরু হত্যা নিষিদ্ধ:

  • কৃষির আধুনিকীকরণ
  • পশুপালনের উন্নতি
  • গাভী ও গবাদি পশুর সংরক্ষণ
    • এটি ভারতীয় সমাজের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের প্রতিফলন।

উদার-বৌদ্ধিক নীতি (Liberal–Intellectual Principles):

উদ্দেশ্য—বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, মানবিক মূল্যবোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি।

৪৪ নং ধারা – অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (Uniform Civil Code):

  • দেশে সকলের জন্য সমান দেওয়ানি আইন।
  • ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিগত আইনের বদলে একক আইনি ব্যবস্থা।

৪৫ নং ধারা – শিশুদের শিক্ষা ও যত্ন:

  • ৬ বছরের নিচে শিশুদের প্রাথমিক যত্ন
  • প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা

(২০০২ সালের ৮৬তম সংশোধনীতে ৬–১৪ বছরের শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার করা হয়।)

৪৮ নং ধারা – বৈজ্ঞানিক কৃষি ও পশুপালন:

  • আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি।
  • পশুপালনের উন্নয়ন।
  • পরিবেশ সুরক্ষা।

৪৮(ক) নং ধারা – পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ:

রাষ্ট্র বাধ্য—

  • পরিবেশ রক্ষা।
  • বন সংরক্ষণ।
    • বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ। ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত।

৪৯ নং ধারা – ঐতিহাসিক স্থান ও স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ:

  • ঐতিহাসিক, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের স্থান সংরক্ষণ।
  • প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষা।

৫০ নং ধারা – বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা:

  • বিচার বিভাগকে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে পৃথক করা।
    • ‘Separation of Judiciary from Executive’.

৫১ নং ধারা – আন্তর্জাতিক শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ:

রাষ্ট্র—

  • আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা।
  • জাতিসংঘের সনদের প্রতি আনুগত্য।
  • আন্তর্জাতিক বিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি।
  • মানবাধিকারের উন্নয়ন।
  • আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান রাখবে।

উপসংহার (Conclusion):

সংবিধানের চতুর্থ অংশের রাষ্ট্রের নীতিনির্দেশক তত্ত্ব ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে। এগুলি আদালতে বলবৎযোগ্য না হলেও রাষ্ট্রকে একটি জনকল্যাণমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিশা দেয়। সমাজতান্ত্রিক নীতি সামাজিক–অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, গান্ধীবাদী নীতি গ্রামস্বরাজ ও দুর্বল শ্রেণির upliftment–কে গুরুত্ব দেয়, আর উদার–বৌদ্ধিক নীতি বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক শান্তির মূল্যবোধকে সুসংহত করে।

মৌলিক অধিকার ব্যক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, আর নির্দেশমূলক নীতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করে—এই দুইয়ের সমন্বয়েই ভারতীয় সংবিধানের পূর্ণতা ও মানবিক আদর্শ স্পষ্ট হয়। তাই DPSP শুধু রাষ্ট্রের নীতি নয়, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগঠনের নৈতিক কম্পাস হিসেবে বিবেচিত।

Protijogita.in শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এম.এ করেছি এবং শিক্ষকতা করি। এই ওয়েবসাইটে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রশ্নোত্তর, মক টেস্ট, এবং দরকারি অধ্যয়ন সামগ্রী প্রদান করা হয়।

Post Comment

error: Content is protected !!