ব্রিটিশ আমলে ভারতের শিক্ষানীতি | British Education Policy in India.
ভূমিকা:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমদিকে ভারতের শিক্ষা বিস্তারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা বিস্তার ও প্রশাসনিক সুবিধা লাভ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ওপর কার্যকর শাসন এবং কেরানি–কর্মচারী তৈরি করার স্বার্থে ব্রিটিশরা নানা শিক্ষানীতি গ্রহণ করে।
ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি অনেকাংশেই ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি হলেও তা ছিল উপনিবেশিক স্বার্থেই প্রণীত।
ব্রিটিশ আমলে গৃহীত প্রধান শিক্ষানীতি ও পদক্ষেপ:
চার্টার অ্যাক্ট, ১৮১৩:
চার্টার অ্যাক্ট ছিল ভারতে ইংরেজ শিক্ষানীতির সূচনা।
মূল বৈশিষ্ট্য:
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা শিক্ষাখাতে ব্যয় করার নির্দেশ।
- ১৮২৩ সাল পর্যন্ত কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি—
কারণ: শিক্ষানীতি নিয়ে ‘Orientalist’ বনাম ‘Anglicist’ বিতর্ক। - ১৮২৩ সালে General Committee on Public Instruction গঠন।
দল দু’টি
- Orientalists: সংস্কৃত, আরবি-পার্সি শিক্ষার পক্ষে।
উদাহরণ: H. T. Princep, H. H. Wilson - Anglicists: পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে।
চার্টার অ্যাক্ট, ১৮৩৩:
- শিক্ষাখাতে বার্ষিক ব্যয় বৃদ্ধি করে ১০ লক্ষ টাকা করা হয়।
- এ সময় থেকেই ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের প্রস্তুতি জোরদার হয়।
মেকলের মিনিট বা মেকলের প্রতিবেদন (Macauley’s Minute), ১৮৩৫:
মেকলে ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ও গভর্নর–জেনারেলের আইন সদস্য।
মেকলের মূল মতামত:
- সরকারি খরচে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা চালুর পক্ষে মত দেন।
- তিনি মনে করেন—উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা ছড়িয়ে পড়লে
তা ক্রমে নিচু স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
একে বলা হয় Infiltration Theory / চুইয়ে পড়া নীতি। - লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ৭ মার্চ ১৮৩৫ মেকলের প্রস্তাব কার্যকর করেন।
অন্য পদক্ষেপ:
- লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪) ঘোষণা করেন—
সরকারি চাকরিতে ইংরেজি শিক্ষিত যুবকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s Despatch), ১৮৫৪:
১৮৫৪ সালের ১৯ জুলাই বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড এটি প্রকাশ করেন।
একে বলা হয় — “ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা”।
উডের ডেসপ্যাচ-এর প্রধান সুপারিশ:
- জনগণের শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের।
- প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষা, উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষা।
- প্রত্যেক প্রদেশে আলাদা Education Department গঠন।
- কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বলা হয়।
- নারী শিক্ষা প্রসারের সুপারিশ।
- বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর।
হান্টার কমিশন (Hunter Commission), ১৮৮২:
লর্ড রিপনের সময় স্যার উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হয়।
উডের ডেসপ্যাচের কার্যকারিতা ও প্রয়োগ পর্যালোচনাই এর উদ্দেশ্য।
গুরুত্বপূর্ণ দিক:
- প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ মনোযোগ।
- পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন ও বিদ্যালয় ব্যবস্থার সুসংগঠন।
- শিক্ষায় স্থানীয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
- ভারতীয় সদস্য: কে টি তিলং, স্যার সৈয়দ আহমেদ প্রমুখ।
র্যালে কমিশন (Raleigh Commission), ১৯০২:
উচ্চশিক্ষার সংস্কারের জন্য এই কমিশন গঠিত হয়।
মহৎগুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- ভারতীয় সদস্য: গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ হুসেন বিলগ্রামী।
- এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গঠিত হয়—
Indian Universities Act, 1904
Indian Universities Act, 1904-এর ফলাফল:
- বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কঠোর হয়।
- পরীক্ষা ও শিক্ষার মানোন্নয়ন।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে সরকারি হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি।
স্যাডলার কমিশন (Sadler University Commission), ১৯১৭–১৯:
এটির অন্য নাম—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন।
উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখা।
প্রধান সুপারিশ:
- বিদ্যালয়ে ১২ বছরের শিক্ষা।
- বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে ২ বছরের ইন্টারমিডিয়েট কোর্স।
- স্নাতক কোর্স ৩ বছর।
- গবেষণা, ফলিত বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি।
ভারতীয় সদস্য:
- স্যার আশুতোষ মুখার্জী
- জিয়াউদ্দিন আহমেদ
হার্টগ কমিটি (Hartog Committee), ১৯২৯:
চেয়ারম্যান: স্যার ফিলিপ হার্টগ।
মূল সুপারিশ:
- প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন।
- পাঠ্যক্রম সহজীকরণ।
- শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় অযথা ভিড় কমানো।
- ড্রপআউট সমস্যা কমানোর পরামর্শ।
ওয়ার্ধা শিক্ষা পরিকল্পনা (Wardha Scheme of Education), ১৯৩৭:
জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৭ সালে ওয়ার্ধায় শিক্ষার জন্য জাতীয় সম্মেলনের আহ্বান করে।
এটি Basic Education বা Nai Talim নামে পরিচিত।
চেয়ারম্যান: ডঃ জাকির হুসেন
প্রধান লক্ষ্য:
- কার্যক্রম-ভিত্তিক শিক্ষা (Learning through Activities)
- হাতে–কলমে কাজের মাধ্যমে শিক্ষা।
- স্বনির্ভরতা ও চরিত্র গঠন।
- মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা।
ব্রিটিশ শিক্ষানীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব:
ইতিবাচক প্রভাব:
- আধুনিক বিদ্যালয়–বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
- বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী চিন্তার বিকাশ।
- সংবাদপত্র, সাহিত্য, জাতীয়তাবোধের প্রসার।
- নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি।
নেতিবাচক প্রভাব:
- শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের কেরানি তৈরি।
- মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- উচ্চশিক্ষা একচেটিয়া হয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত থাকে।
- বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়।
উপসংহার
ব্রিটিশ আমলে ভারতের শিক্ষানীতি ছিল উপনিবেশিক শাসন মজবুত করার হাতিয়ার। যদিও এর মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞানমনস্কতা ও জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে, তবে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জনসম্পদকে প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা। স্বাধীনতা–পরবর্তী ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও গণমুখীকরণ মূলত এই উপনিবেশিক শিক্ষানীতির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নির্মিত হয়েছে।



Post Comment