ভারতীয় সংবিধানে সাম্যের অধিকার | Right to Equality (Articles 14–18).

ভারতীয় সংবিধানের সাম্যের অধিকার

ভারতীয় সংবিধানে সাম্যের অধিকার | Right to Equality (Articles 14–18).

ভারতীয় সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকারগুলির একটি হল সাম্যের অধিকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হলো—সমস্ত নাগরিক সমান মর্যাদা, সমান সুযোগ ও সমান অধিকার ভোগ করবে। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ থেকে ১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার ঘোষণা ও সুরক্ষিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, আইন, প্রশাসন ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো নাগরিককে অন্যায়ভাবে বৈষম্যের শিকার হতে দেওয়া হবে না।

সাম্যের সাধারণ অর্থ:

সাধারণভাবে “সাম্য” বলতে বোঝায়—
সমস্ত মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সমতা নিশ্চিত করা।
এই অধিকার শুধু আইনি সমতা নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি বহন করে।

ধারা ১৪: আইনগত সাম্য (Equality Before Law & Equal Protection of Laws)

ধারা ১৪-তে সাম্যের অধিকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে গঠিত—

আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality Before Law):

এটি ব্রিটিশ সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ এ. ভি. ডাইসির “Rule of Law” তত্ত্বের অনুসরণে গৃহীত। এর মূল ধারণা—

  • সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান
  • কোনো ব্যক্তি আইন ও রাষ্ট্রের ওপর নয়
  • ক্ষমতা বা পদমর্যাদা নির্বিশেষে সবার জন্য আইনের শাসন এক ও অভিন্ন

তবে ভারতের মতো বিশাল দেশে এই নীতির কিছু বাস্তব ব্যতিক্রম আছে:

  • পুলিশ, প্রশাসন, বিচারবিভাগের নির্দিষ্ট ক্ষমতা
  • রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায় না (সংবিধানের ৩৬ নং ধারা)
  • সংসদ ও বিধানসভার সদস্যদের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষাধিকার রয়েছে

আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার (Equal Protection of Laws):

এটি মার্কিন সংবিধানের ফোরটিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট থেকে গৃহীত।

এর মূল অর্থ—

  • সমপর্যায়ভুক্ত সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রয়োগ হবে
  • ভিন্ন পরিস্থিতি, ভিন্ন প্রয়োজন ও ভিন্ন শ্রেণির ভিত্তিতে যুক্তিসঙ্গত শ্রেণিবিভাগ করা যায়
  • তবে সেই শ্রেণিবিভাগ যুক্তিযুক্ত (reasonable classification) হতে হবে, বৈষম্যমূলক নয়

উদাহরণ:
অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুবিধা, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক সুযোগ—এসবই যুক্তিসঙ্গত শ্রেণিবিভাগের উদাহরণ।

ধারা ১৫: বৈষম্য নিষিদ্ধকরণ (Prohibition of Discrimination)

ধারা ১৫ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে—

রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের প্রতি নিম্নোক্ত কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না—

  • ধর্ম
  • বর্ণ
  • জাত
  • লিঙ্গ (স্ত্রী/পুরুষ)
  • জন্মস্থান

এছাড়া কোনো নাগরিককে নিম্নোক্ত ব্যবহারিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না—

  • দোকান
  • হোটেল
  • রেস্তোরাঁ
  • বিনোদনাগার
  • রাষ্ট্রের অর্থে নির্মিত জলাশয়, রাস্তা, ঘাট ও আশ্রয়স্থল

ধারা ১৫(৩) ও ১৫(৪): বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি:

তবে রাষ্ট্র নিম্নোক্ত শ্রেণির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে—

  • নারী
  • শিশু
  • সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসর শ্রেণি
  • তপশিলি জাতি (SC)
  • তপশিলি উপজাতি (ST)

এই শ্রেণির upliftment-এর জন্য সংরক্ষণ, বিশেষ বৃত্তি, শিক্ষায় ও চাকরিতে সুবিধা দেওয়া— সবই সংবিধানসম্মত।

ধারা ১৬: সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ (Equality of Opportunity in Public Employment)

ধারা ১৬ অনুযায়ী—

  • সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার
  • নিয়োগ, বেতন, পদোন্নতি, পেনশনসহ চাকরির সব ক্ষেত্রে বৈষম্য নিষিদ্ধ
  • ধর্ম, লিঙ্গ, জাত, বর্ণ, জন্মস্থান ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য করা যাবে না

ধারা ১৬-এর ব্যতিক্রম:

রাষ্ট্র যুক্তিসঙ্গত কারণে—

  • অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ দিতে পারে
  • ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের চাকরি সংরক্ষণ করতে পারে
  • সংসদ আইন করে নির্দিষ্ট রাজ্যের চাকরির ক্ষেত্রে বাসস্থান যোগ্যতা আবশ্যক করতে পারে

এভাবে ধারা ১৬ সমানাধিকার নিশ্চিত করলেও সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় নমনীয়তাও বজায় রেখেছে।

ধারা ১৭: অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণ (Abolition of Untouchability)

ভারতের সামাজিক জীবনে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত অস্পৃশ্যতা প্রথা সংবিধানের ১৭ নং ধারায় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

  • ১৯৫৫ সালে পাস হয় “Protection of Civil Rights Act”
  • অস্পৃশ্যতা চর্চা বা কাউকে বর্জন করার জন্য শাস্তির বিধান
  • SC/ST সম্প্রদায়কে মর্যাদা ও সমান অধিকার দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

ধারা ১৭ ভারতীয় গণতন্ত্রে মানবিক মর্যাদার সুরক্ষার শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করেছে।

ধারা ১৮: উপাধি নিষিদ্ধকরণ (Abolition of Titles)

গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষের মর্যাদা ও মর্যাদাগত সমতা রক্ষার স্বার্থে ধারা ১৮ ঘোষণা করে—

  • কোনো ভারতীয় নাগরিক বিদেশী রাষ্ট্র বা দেশীয় কোনো উপাধি বা পদবি গ্রহণ করতে পারবে না
  • সামরিক বা শিক্ষাগত সম্মানসূচক উপাধিতে (যেমনঃ ডক্টরেট, গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড) এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়
  • ব্রিটিশ আমলের “Sir”, “Rai Bahadur”, “Khan Bahadur” ইত্যাদি উপাধির পুনরাবৃত্তি চিরতরে নিষিদ্ধ

ধারা ১৮ সমাজে সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের ভেদরেখা দূর করে সমতার নীতি সুসংহত করতে সাহায্য করে।

উপসংহার:

সাম্যের অধিকার ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম মৌলিক অধিকার, যা নাগরিকদের সামাজিক ন্যায়, আইনি সুরক্ষা ও সমান সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদান করে। ধারা ১৪ থেকে ১৮ কেবল বৈষম্য নিষিদ্ধ করে না, বরং সমাজের দুর্বল ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর upliftment-এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পথও সুগম করে। ফলে ভারতীয় গণতন্ত্রে সমতা শুধু একটি নীতি নয়, বরং বাস্তব জীবনে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি সক্রিয় উপায়।

এই অধিকারগুলির সঠিক প্রয়োগই ভারতবর্ষকে একটি সমতাভিত্তিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে।

Protijogita.in শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এম.এ করেছি এবং শিক্ষকতা করি। এই ওয়েবসাইটে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রশ্নোত্তর, মক টেস্ট, এবং দরকারি অধ্যয়ন সামগ্রী প্রদান করা হয়।

Post Comment

error: Content is protected !!