ভক্তিবাদ ও সুফিবাদ আন্দোলন:

ভক্তিবাদ ও সুফিবাদ আন্দোলন:

ভক্তিবাদ কি? (সগুণ ও নির্গুণ সাধক) 

সগুণ সাধক: 

  • সাকার ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। 
  • রাম ও কৃষ্ণ পূজার মধ্য দিয়ে এঁরা ভগবান বিষ্ণুকে পূজা করতেন। 
  • সামাজিক রীতিনীতি বিষয়ে তেমন কিছু উদার নয়। 
  • রামানন্দ, সুরদাস, তুলসীদাস, চৈতন্যদেব ছিলেন সগুণ সাধক। 

নির্গুণ সাধক: 

  • নিরাকার ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। 
  • জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরোধী। 
  • ব্রাহ্মণবাদী আচার সর্বস্বতার প্রবল বিরোধী। 
  • সামাজিক রীতিনীতি বিষয়ে অত্যন্ত উদার। 
  • ভক্তিবাদের প্রথম প্রচার করেন রামানুজ (তামিল)-দ্বাদশ শতাব্দীতে। 
  • প্রথম ভক্তিসন্তঃ রামানন্দ (রামের উপাসক)। তিনি ছিলেন রাঘবানন্দের শিষ্য। 
  • রাঘবানন্দ ছিলেন রামানুজের শ্রী সম্প্রদায়ের লোক। 
  • রামানন্দের প্রধান শিষ্য- কবীর (তাঁতী)। 
  • রামানুজ রাঘবানন্দ রামানন্দ কবীর নামদেব ভক্তদাদু। 

কবীর: জন্ম 1398 সাল। (1398-1518) 

  • কবীর ছিলেন রামানন্দের প্রধান শিষ্য। 
  • কবীর বাল্যকালে মুসলমান তাঁতী (জোলা)-র ঘরে পালিত হয়েছিলেন। কিন্তু কিংবদন্তী আছে যে, কাশ্মীরে এক ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম হয়। 
  • নীরু নামে এক তাঁতীর ঘরে প্রতিপালিত হন। 
  • রামানন্দের মতো কবীরও একেশ্বরবাদবাদী ছিলেন। 
  • কবীর বলতেন, যিনি আল্লাহ্ তিনিই রাম। 
  • তিনি বলতেন হিন্দু ও মুসলমান একই মাটি দিয়ে গড়া দুটি পাত্র। “রাম রহিম এক হ্যায়, নাম ধারা দো হ্যায়”- কবীর। 
  • কবীরের দু’লাইনের কবিতাগুলো কবীরের দোঁহার নামে খ্যাত। দোঁহার লেখক সুরদাস। এগুলি হিন্দিতে লেখা। 
  • কবীর- বিজাক এর রচয়িতা। 

রামানন্দের প্রধান শিষ্য ছিলেন- 12 জন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- 

  1. কবীর-মুসলমান তাঁতী (Weaver)। 
  2. সুলতান সিকন্দর লোদী কবীরকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। 
  3. রবিদাস-মুচী (Cobbler)। 
  4. সাধন কসাই-কসাই (Butcher)। 
  5. নামদেব-দর্জি (মহারাষ্ট্রে প্রচার করেন)। 
  6. শাহিন (Sena)-নাপিত (Barber)। 
  • রামানন্দ হিন্দিভাষাতে একেশ্বরবাদ প্রচার করতেন (Tailor) (দর্জি)। 
  • মহারাষ্ট্রে ভক্তিবাদী ধর্মমত সর্বপ্রথম প্রচার করেন- গুরু নামদেব (রামানন্দের শিষ্য)। তিনিও গুরুর মতো একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। 

নানক (1469-1539): 

  • শিখ ধর্মের প্রবর্তক। 1469 সালে জন্ম। 
  • লাহোরের তালবন্দী গ্রামে (বর্তমান নাম নামকানা) তার জন্ম 1469 সালে। 
  • ‘Janamsakhi’ is the biography of Guru Nanak birth stories (Like-Bala, Miharban, Adi, Puratan). 
  • শিখ কথাটির অর্থ শিষ্য। 
  • শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেব-এ নানকের উপদেশাবলী লিপিবদ্ধ করা আছে। 
  • শিখদের প্রথম ধর্মগুরু-গুরুনানক। 
  • তিনি 1539 সালে মারা যান। 

চৈতন্যদেব (1486-1533 সাল): 

  • বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক। 
  • ভারতে ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রধান পুরোহিত। 
  • ভক্তি আন্দোলনের তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়। 
  • 1486 সালে নবদ্বীপের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে দোল পূর্ণিমার দিন জন্মগ্রহণ করেন। 
  • পিতা জগন্নাথ মিশ্র (নবদ্বীপে অধ্যাপনা করতেন)। 
  • মাতা: শচীদেবী। 
  • চৈতন্যদেবের আদি নিবাস ছিল- শ্রীহট্ট। 
  • শ্রীচৈতন্যদেবের বাল্য নাম-বিশ্বম্ভর। 
  • মা-বাবা আদর করে ডাকতেন-নিমাই। 
  • গায়ের রং খুবই ফর্সা বলে প্রতিবেশীরা তাঁকে গৌরাঙ্গ, গৌর, গোরা ইত্যাদি নামেও ডাকত। 
  • তিনি গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে শিক্ষালাভ করেন। 
  • 24 বছর বয়সে (কেশব ভারতীর কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন)। 
  • কেশবভারতী তাঁর নাম দেন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। 

বৈষ্ণব সাহিত্য ও লেখক: 

  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-চণ্ডীদাসের লেখা। 
  • চৈতন্য ভাগবৎ-বৃন্দাবন দাসের লেখা। 
  • চৈতন্য চরিতামৃত-কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা। 
  • শ্রীকৃষ্ণবিজয়-মালাধর বসু। 
  • যবন হরিদাস ছিলেন চৈতন্যদেবের শিষ্য। হরিদাস মুসলমান ছিলেন। 
  • উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্রদেব চৈতন্যদেবের ভক্ত ছিলেন। 
  • অন্যান্য শিষ্য ছিলেন-নিত্যানন্দ, শ্রীরাম, জীবগোস্বামী এবং রূপ ও সনাতন নামে দুই ভাই। 
  • 1533 সালে 9ই জুলাই পুরীধামে তাঁর তিরোধান ঘটে। 
  • মধ্যযুগে নবদ্বীপকে বাংলার অক্সফোর্ড বলা হত। 
  • “মেরেছ কলসীর কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না”- শ্রীচৈতন্যের কথা। 
  • চৈতন্যদেবের দুই বিবাহ-প্রথম স্ত্রী লক্ষ্মী (সাপের কামড়ে মারা যান), দ্বিতীয় স্ত্রী: বিষ্ণুপ্রিয়া। 

মীরাবাঈ (রাজস্থান) (1498-1539): 

  • মেবারের রাণা সঙ্গের পুত্রবধূ। 
  • কর্নেল অটসাহেব মীরাবাঈকে মেবারের রাণা কুম্ভের মহিষী বলেছেন। 
  • মীরার পদাবলী-রাজস্থানী ভাষায় রচিত হয়েছিল (ব্রজবুলী ভাষা)। 

ভক্ত দাদু (1544-1603): 

  • আমি হিন্দুও নই, মুসলিমও নই, আমি পরম কারণীক ঈশ্বরকে ভালবাসি-দাদু বলতেন। 
  • আকবরের সঙ্গে দাদুর সম্পর্ক ছিল। 
  • আল্লা ও রামের ভ্রম আমার ছুটেছে, হিন্দু ও তুর্কীতে কোন ভেদ নেই-দাদু। 
  • পেশায় চর্মকার ছিলেন এবং নিরক্ষর ছিলেন। 
  • শয়কবধুন-এর কাছে (রিয়া সম্প্রদায়ের শিষ্য)-এর শিষ্যত্ব তিনি নিয়েছিলেন। 
  • কিন্তু কবীরকে গুরুর ন্যায় জ্ঞান করতেন। 
  • ভক্ত দাদুর অনুরাগীদের ‘ব্রহ্ম-সম্প্রদায়’ নামে অভিহিত করা হয়। 

অন্যান্য: 

  • আসামে ভক্তিবাদের প্রচার করেন- শঙ্করদেব। 
  • ভক্তিবাদের এক বিখ্যাত প্রবক্তা ছিলেন- বল্লভাচার্য (তেলেগু)। তিনি কৃষ্ণ ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি পুস্তি গোষ্ঠীভুক্ত যা বৈষ্ণব ধর্মের একটি উপশাখা। এর দর্শন ছিল শুদ্ধ অদ্বৈত। 
  • সুরদাস সুর-সাগর, সুর-সাবাবলী, সাহিত্য লাহোরী রচনা করেন। 
  • তুলসীদাস (বারাণসী)-রামচরিত মানস, গীতাবলী, কবিতাবলী, বিনয় পত্রিকার রচয়িতা। তিনি রামনন্দী সম্প্রদায়ের দর্শন মেনে চলতেন। 
  • নরসিংহ মেহতা: মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় ভজন Vishnava jan ka-এর লেখক। 
  • সুলতানী যুগে উর্দু ভাষার উৎপত্তি হয়-আরবী, ফার্সি, তুর্কী ভাষার সঙ্গে হিন্দী ভাষার সংমিশ্রণ। 
  • ভক্তিরত্নাকর- নরহরি চক্রবর্তী 
  • কুকা আন্দোলন- গুরু রাম সিংহ। 
  • ‘কবিকঙ্কন চণ্ডী’- মুকুন্দরাম চক্রবর্তী 
  • চৈতন্য মঙ্গল- জয়ানন্দ/ত্রিলোচন দাস 
  • প্রেঝটিকা- রাসখানা 
  • গোয়ালিয়ারের রাজা মানসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মান কৌতূহল’ রচিত হয়। 
  • ‘Immortal Homer of East’- ফিরদৌসীকে বলা হয়। 
  • সুলতানি যুগে আরবী, ফার্সী ও তুর্কী ভাষার সঙ্গে ভারতীয় হিন্দী ভাষার সংমিশ্রণে উর্দুর উৎপত্তি। 
  • তুর্কীরা আসল খিলান পদ্ধতিতে অট্টালিকা নির্মাণ করত। 
  • হিন্দুরা বীম ও নকল খিলান পদ্ধতিতে অট্টালিকা নির্মাণ করত। 
  • দক্ষিণ ভারতের মন্দির নগরী পেরামবুদুরে জন্মগ্রহণ করেন-রামানুজ। 
  • বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাসী; বিষ্ণু ও কৃষ্ণের উপাসক এবং ভক্তিবাদের সমর্থক দক্ষিণ ভারতের তামিল জনগোষ্ঠীর একটি শাখা ছিল আলভার সম্প্রদায়।

সুফীবাদ কি?

  • ‘সুফী’ শব্দটি আরবি শব্দ ‘সাফা’ থেকে এসেছে। ‘সুফ’ শব্দের অর্থ-পবিত্র জীবনযাপন। 
  • যারা মোটা পশমের বস্ত্র পরতো তাদের সুফী বলা হত। 
  • সুফীবাদের উৎস কোরান (‘Sufism was born in the bosom of Islam- ইউসুফ হুসেন) 
  • মূল কথা-ঈশ্বর এক এবং সবকিছুই ঈশ্বরের অংশ। 
  • সুফিবাদকে তার অনুসারীরা ইসলামের অভ্যন্তরীণ, রহস্যময় মাত্রা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। কিছু সুফি সম্প্রদায় ধর্মীয় যিকির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে অথবা সেমায় বিভিন্ন ধরণের উপাসনা অন্তর্ভুক্ত থাকে যেমন আবৃত্তি, গান (কাওয়ালি), সঙ্গীত (যন্ত্র), নৃত্য, ধূপ, ধ্যান, পরমানন্দ এবং সমাধি। 
  • ভারতের সুফিরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার মাধ্যম হিসেবে সামা ও রাগ (শ্রবণ ও নৃত্য) গ্রহণ করেছিলেন। সামা তাদের আধ্যাত্মিক চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিলেন। 
  • চিস্তি – কিছু সাধক কঠোর অনুশীলন এবং নিয়ন্ত্রিত শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন করতেন। 

বিভিন্ন সুফি সম্প্রদায় ও তাদের প্রতিষ্ঠাতা: 

সম্প্রদায়প্রতিষ্ঠাতা
চিস্তি খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি 
মাদারী বাবা মাদার শাহ
সুহরাবর্দি শেখ শিহাবুদ্দিন সুরাবর্দী
রাসানিয়া মিঞা বায়াজিদ আনসারি (পীর রোসন)
কাদিরি নিয়মত উল্লাহ (ভারত)
শেখ আব্দুল কাদের জিলানী (বাগদাদ)
মহাদেবী মুল্লা মহম্মদ মাহদি 
শাত্তারি আব্দুল্লা শাত্তারি 
রিসি নুরউদ্দিন নুরানি 
নকসবন্দী খাজা বাকী বিল্লাহ 
কালান্দারিয়া আবু ওয়ালি কালান্দার 

চিন্তি সম্প্রদায়: 

  • প্রতিষ্ঠাতা: খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি। আজমীঢ়ের লোক। 
  • এদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেন-নিজামউদ্দীন আওলিয়া। আলাউদ্দিন খলজী তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। 
  • তাঁর শিষ্য নাসিরউদ্দীন ‘চিরাগ-ই-দিল্লী’ বা দিল্লীর প্রদীপ নামে পরিচিত ছিলেন। 
  • তিনি Yogic breathing exercise করেন। তাঁকে অনেকে সিদ্ধপুরুষ বা পূর্ণপুরুষ বলে উল্লেখ করেন। 
  • ভারতের তোতাপাখী আমীর খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারনী-চিন্তি সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। 
  • খাজা কুতুবউদ্দীন কাকী ছিলেন খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির অন্যতম শিষ্য। 
  • দিল্লী এবং দোয়াব অঞ্চলে এদের জনপ্রিয়তা বেশী ছিল। 
  • খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির অন্য বিখ্যাত শিষ্য হলেন-শেখ হামিদুদ্দীন নাগৌরী। 
  • সুফিরা যেখানে থাকে তাকে Khangah (খানকা বা দরগা) বলে। শিষ্যদেরকে ফকির বা দরবেশ বলে। 

সুরাবর্দী সম্প্রদায়: 

  • পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলে এর প্রভাব বেশী ছিল। 
  • শেখ সিহাবউদ্দীন সুরাবর্দী এবং বহাউদ্দীন জাকারিয়া এই সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। 

সিলসিলা সম্প্রদায়: 

  • প্রতিষ্ঠাতা: ফিরদৌসী (বিহার)

Post Comment