ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা: কাঠামো, প্রক্রিয়া, নিয়ম ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ৷ Electoral System of India.
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার গুরুত্ব:
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এখানে সরকার গঠনের মূল ভিত্তি হলো স্বাধীন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং সেই প্রতিনিধিরাই কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয় পর্যায়ে সরকার পরিচালনা করেন।
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা একদিকে যেমন বহুস্তরীয়, তেমনই এটি সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত ও নির্বাচন কমিশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
ভারতে তিন ধরনের সরকার:
ভারত একটি সংঘীয় রাষ্ট্র (Federal System)। তাই এখানে তিনস্তর বিশিষ্ট সরকার রয়েছে—
- কেন্দ্র সরকার
- রাজ্য সরকার
- স্থানীয় সরকার (পঞ্চায়েত ও পৌরসভা)
কেন্দ্রীয় নির্বাচন: লোকসভা নির্বাচন:
লোকসভা কি?
লোকসভা হল ভারতের জনপ্রতিনিধিদের নিম্নকক্ষ, যেখানে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
লোকসভা নির্বাচনের কাঠামো
- পুরো দেশ ৪৪৩টি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত।
- প্রতিটি এলাকা একজন সংসদ সদস্য (MP) নির্বাচন করে।
- দল বা জোট যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তারা সরকার গঠন করে।
রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচন: বিধানসভা নির্বাচন
বিধানসভা নির্বাচন কী?
প্রতিটি রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য MLA বা বিধায়ক নির্বাচন করা হয়।
বৈশিষ্ট্য
- প্রতিটি রাজ্য একাধিক নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত।
- প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা একজন করে MLA নির্বাচন করে।
- যেই দল বা জোট অধিক আসন পায়, তারা সরকার গঠন করে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন:
স্থানীয় স্তরে দুই ধরনের নির্বাচন হয়—
✔ পঞ্চায়েত নির্বাচন (গ্রামীণ অঞ্চল)
✔ পৌরসভা/নগর নিগম নির্বাচন (নগর অঞ্চল)
এখানে প্রতিটি গ্রাম/শহর আবার ওয়ার্ডে ভাগ করা থাকে, এবং প্রতিটি ওয়ার্ড একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে।
নির্বাচনী এলাকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা:
ভারত সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—
সামাজিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
কেন সংরক্ষণ প্রয়োজন?
- সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যাতে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে
- প্রভাবশালী ও ধনী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেওয়া
- সর্বজনীন রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
কোন কোন আসন সংরক্ষিত?
সংরক্ষণ দুটি শ্রেণির জন্য—
✔ তফসিলি জাতি (SC)
✔ তফসিলি উপজাতি (ST)
১ সেপ্টেম্বর ২০১২ পর্যন্ত:
- এসসি – ৮৪ আসন
- এসটি – ৪৭ আসন (লোকসভায়)
স্থানীয় স্তরে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ
পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় ৩৩% আসন শুধুমাত্র মহিলা প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত।
ভোট গ্রহণ ব্যবস্থা: সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার:
ভারতে ভোটাধিকার নির্ভর করে Universal Adult Franchise নীতির উপর।
ভোট দেওয়ার যোগ্যতা:
- নাগরিক হতে হবে
- বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব
- ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, আয়, শিক্ষা কোনোটাই বাধা নয়
ভোটার তালিকা (Electoral Roll)
ভোটার নিশ্চিত করতে—
- প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার ভোটার তালিকা তৈরি হয়
- মৃত এবং স্থানান্তরিত ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হয়
- নতুন যোগ্য নাগরিকদের নাম যুক্ত হয়
- প্রতি ৫ বছরে পূর্ণ সংশোধন হয়
- নির্বাচন আগে তালিকা প্রকাশ করে ভুল সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়
প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়া:
✔ প্রার্থী হতে হলে যোগ্যতা:
- বয়স কমপক্ষে ২৫ বছর
- মানসিকভাবে সক্ষম
- কোনো গুরুতর অপরাধমূলক দণ্ড থাকা যাবে না
✔ মনোনয়ন প্রক্রিয়া
- রাজনৈতিক দল “দলীয় টিকিট” দেয়
- প্রার্থী মনোনয়ন ফর্ম জমা দেয়
- নির্দিষ্ট পরিমাণে নিরাপত্তা জামানত (Security Deposit) জমা দিতে হয়
- নিজের সম্পত্তি, ঋণ, বিচারাধীন মামলা, শিক্ষাগত যোগ্যতা—এসব হলফনামা হিসেবে প্রকাশ করতে হয়
এই নিয়মটি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক।
প্রার্থীর জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন আছে কি?
ভারতে—
- ভোটারদের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না
- প্রার্থীদের জন্যও শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক নয়
কারণ:
সংবিধান অনুসারে প্রতিনিধি হওয়ার মূল যোগ্যতা হলো—
✔ মানুষের সমস্যা বোঝা
✔ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা
✔ জনসেবার ক্ষমতা থাকা
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ভোটারদের।
নির্বাচনী প্রচারণা (Election Campaign):
প্রচারণা চলাকালীন—
- দলগুলি সভা, মিছিল, সমাবেশ করে
- টিভি, রেডিও, পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার দেয়
- ভোটারদের কাছে নীতি, পরিকল্পনা উপস্থাপন করে
- প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাথে মুক্ত গণতান্ত্রিক আলোচনার সুযোগ হয়
প্রচারের সময়সীমা – সাধারণত ১৪ দিন
(প্রার্থীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত)
নির্বাচনী আচরণ বিধি (Model Code of Conduct – MCC):
এটি সকল দল ও প্রার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক।
যা করা যাবে না:
- ঘুষ ও ভয় দেখানো
- বর্ণ/ধর্মের নামে ভোট চাওয়া
- সরকারি গাড়ি, ভবন, কর্মী ব্যবহার
- লোকসভায় ২২ লক্ষের বেশি ব্যয়
- বিধানসভায় ১০ লক্ষের বেশি ব্যয়
- মসজিদ/মন্দির/গির্জায় প্রচারণা
- নির্বাচনের আগে নতুন প্রকল্প ঘোষণা
✔ যা করতে হবে:
- নিয়ম ভাঙলে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে
- কমিশনের নির্দেশ মেনে চলতে হবে
ভোটদান প্রক্রিয়া
ভোটদানের দিনে
- এটি সরকারি ছুটির দিন থাকে
- ভোটার তার নিবন্ধিত ভোটকেন্দ্রে যায়
- পরিচয়পত্র যাচাইয়ের পর আঙুলে কালি দেওয়া হয়
- ভোটার EVM-এ বোতাম চেপে ভোট দেন
EVM (Electronic Voting Machine):
EVM দুটি অংশে বিভক্ত—
✔ ব্যালট ইউনিট (Button Panel)
✔ কন্ট্রোল ইউনিট (Polling Officer Controls)
ভোটগ্রহণ শেষে—
- EVM সিল করা হয়
- নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করা হয়
- পরে গণনার দিনে ফলাফল ঘোষণা হয়
ভারতের নির্বাচন কমিশন: স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা:
✔বৈশিষ্ট্য:
- সম্পূর্ণ স্বাধীন
- রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন
- কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকার তাকে প্রভাবিত করতে পারে না
- নির্বাচনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নেয়
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা:
- নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা
- আচরণবিধি কার্যকর
- সরকারি কর্মীদের বদলি/তদারকি
- নির্বাচন পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ
- লঙ্ঘনকারী দল/প্রার্থীকে শাস্তি প্রদান
নির্বাচনের ফলাফল ও গ্রহণযোগ্যতা:
ভারতে সাধারণত—
- পরাজিত দলও নির্বাচনের রায় মেনে নেয়
- ফলাফলকে জনগণের ম্যান্ডেট হিসেবে সম্মান করে
- নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার প্রমাণ এটি যে
- বহুবার ক্ষমতাসীন সরকার পরাজিত হয়েছে
- কেন্দ্রে ও রাজ্যে নিয়মিত সরকার পরিবর্তন ঘটে
গত ১৫ বছরে ৩টির মধ্যে ২টি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হেরেছে, যা প্রমাণ করে নির্বাচন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।
ভারতের নির্বাচন—গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ:
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্বের কাছে অন্যতম সফল গণতান্ত্রিক মডেল।
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বচ্ছ ভোটদান প্রক্রিয়া, EVM-এর দ্রুততা এবং আচরণবিধির কঠোরতা—সব মিলিয়ে ভারতকে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকরী গণতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে।



Post Comment