ভারতের সংবিধানে জরুরি অবস্থা: প্রকারভেদ ও গুরুত্ব: Emergency in the Indian Constitution.
ভূমিকা:
ভারত একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এখানে সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন। তবে কোনো রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় এমন সংকট মুহূর্ত আসতে পারে, যখন সাধারণ সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। সেই অবস্থায় রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। এই কারণেই ভারতীয় সংবিধানে জরুরি অবস্থা সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংবিধানের অষ্টাদশ অধ্যায়ে (১৮তম অধ্যায়) রাষ্ট্রপতির হাতে এই বিশেষ ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। মূলত জার্মান সংবিধান থেকে এই ধারা গৃহীত হয়েছে।
ভারতের রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৫২, ৩৫৬ ও ৩৬০ ধারার অধীনে তিন প্রকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এগুলি হলো –
- জাতীয় জরুরি অবস্থা (National Emergency)
- রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা (President’s Rule)
- আর্থিক জরুরি অবস্থা (Financial Emergency)
জাতীয় জরুরি অবস্থা (ধারা ৩৫২):
সংবিধানের ৩৫২ (১) ধারা অনুসারে, যদি যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বা তার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে রাষ্ট্রপতি জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
তবে ৪৪তম সংবিধান সংশোধন আইন (১৯৭৮) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি এই ঘোষণা করার আগে মন্ত্রীপরিষদের (Cabinet) সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
জাতীয় জরুরি অবস্থার বৈশিষ্ট্য:
- ঘোষণার পর ১ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অনুমোদন পেতে হবে।
- উভয় কক্ষের মোট সদস্যের অর্ধেক এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি প্রয়োজন।
- অনুমোদনের পর এই জরুরি অবস্থা ৬ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকে এবং পুনরায় অনুমোদনের মাধ্যমে এর মেয়াদ বাড়ানো যায়।
- জরুরি অবস্থার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, এবং রাষ্ট্রের একক কাঠামো আরও দৃঢ় হয়।
- নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) কিছু ক্ষেত্রে স্থগিত রাখা যেতে পারে।
ইতিহাসে তিনবার জাতীয় জরুরি অবস্থা:
- ১৯৬২ সালে — চীনের আক্রমণের সময়।
- ১৯৭১ সালে — ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়।
- ১৯৭৫ সালে — দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটাপন্ন পরিস্থিতির জন্য (ইন্দিরা গান্ধীর আমলে), যা গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে পরিচিত।
রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা (ধারা ৩৫৬):
ভারতের সংবিধান কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে। তবে কখনও কখনও কোনো রাজ্যে এমন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যখন সংবিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা সম্ভব হয় না।
এই অবস্থায় রাজ্যপাল যদি মনে করেন যে রাজ্য সরকার সংবিধান মেনে কাজ করতে পারছে না, তবে তিনি রাষ্ট্রপতিকে এই মর্মে সুপারিশ করতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালের সুপারিশের ভিত্তিতে বা নিজের বিবেচনায় ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসন (President’s Rule) জারি করতে পারেন।
রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থার বৈশিষ্ট্য:
- ঘোষণার ২ মাসের মধ্যে এটি লোকসভা ও রাজ্যসভা উভয় কক্ষে অনুমোদিত হতে হয়।
- অনুমোদিত হলে এই জরুরি অবস্থা ১ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি সর্বাধিক ৩ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়।
- এই সময়ে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা ভেঙে যায় এবং প্রশাসন সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চলে আসে।
- রাজ্য বিধানসভা স্থগিত বা ভেঙে দেওয়া হতে পারে।
রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থার ইতিহাস:
ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে বহুবার ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এটি রাজনৈতিক কারণে অপব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে সর্বোচ্চ আদালত (Supreme Court) ১৯৯৪ সালের বোম্মাই মামলা (S.R. Bommai vs. Union of India)-তে এই ধারার ব্যবহারকে সীমিত করার নির্দেশ দেয়।
আর্থিক জরুরি অবস্থা (ধারা ৩৬০):
সংবিধানের ৩৬০ ধারা অনুসারে, যদি দেশের আর্থিক স্থিতি বিপন্ন হয় বা কোনো অংশে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
আর্থিক জরুরি অবস্থা বৈশিষ্ট্য:
- ঘোষণার ২ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অনুমোদন প্রয়োজন।
- এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
- রাজ্যগুলিকে অর্থনৈতিক বিষয়ে কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে চলতে হয়।
- তবে ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনো আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি।
জরুরি অবস্থার প্রভাব ও গুরুত্ব:
জরুরি অবস্থা রাষ্ট্রকে সংকট মুহূর্তে রক্ষা করার একমাত্র সাংবিধানিক উপায়। এর মাধ্যমে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। তবে এর অপব্যবহার হলে গণতান্ত্রিক অধিকার হুমকির মুখে পড়তে পারে।
১৯৭৫ সালের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে, জরুরি অবস্থার ক্ষমতা ব্যবহার করতে হলে রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি সংসদ, বিচারব্যবস্থা ও নাগরিক সমাজের সতর্কতা অপরিহার্য।
উপসংহার:
ভারতের সংবিধানে জরুরি অবস্থা সম্পর্কিত ধারা রাষ্ট্রকে প্রয়োজনে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দেয়। এর ফলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা সম্ভব হয়, কিন্তু গণতন্ত্রের ভারসাম্যও রক্ষা করা জরুরি। তাই বলা যায়—
“জরুরি অবস্থা একটি প্রয়োজনীয় কিন্তু বিপজ্জনক অস্ত্র; এর সঠিক ব্যবহার রাষ্ট্রকে রক্ষা করে, আর অপব্যবহার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে।”



Post Comment