গুপ্ত সাম্রাজ্য: প্রতিষ্ঠা, বিস্তার, শাসকগণ ও তাদের কৃতিত্ব | Gupta Empire.
ভূমিকা:
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করেছিল। কুষাণ ও সাতবাহন শাসকরা কিছুটা স্থিতিশীলতা আনলেও খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে এই দুই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৈদেশিক আক্রমণও স্থিতিশীলতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থান ভারত উপমহাদেশে নতুন রাজনৈতিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূচনা করে। এই কারণেই গুপ্ত যুগকে ভারতীয় ইতিহাসে “স্বর্ণযুগ” বলে উল্লেখ করা হয়।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা (Foundation of Gupta Empire)
শ্রীগুপ্ত: গুপ্ত বংশের সূচনা:
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীগুপ্ত (২৭৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি মূলত বিহার ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশে শক্তিশালী সামন্তশাসক হিসেবে কুষাণদের অধীনে ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ক্রমে তিনি স্বাধীন শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। যদিও তাঁর সাম্রাজ্য ছোট ছিল, তবু তিনিই গুপ্ত বংশের ভিত্তি স্থাপন করেন।
মূল তথ্য:
- অঞ্চল: বিহার ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশ
- সময়কাল: আনুমানিক ২৭৫ খ্রিস্টাব্দ
- সমাজ: বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত (সম্ভাব্য)
- শাসনপদ্ধতি: কুষাণ সামন্ত থেকে স্বাধীন শাসক
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (Chandragupta I) – প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
রাজত্বকাল: ৩১৯/২০ – ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে উল্লিখিত। তিনি শক্তিশালী লিচ্ছবি বংশের রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করেন, যা তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে। লিচ্ছবি বংশ ছিল গঙ্গার উপত্যকার বড় শক্তি — এই কারণে চন্দ্রগুপ্ত বিশাল ভূখণ্ডে কর্তৃত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হন।
চন্দ্রগুপ্ত-I এর কৃতিত্ব (Achievements of Chandragupta I)
১. গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা
- চন্দ্রগুপ্ত-I কে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
- তিনি সামন্তশাসক থেকে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
- তাঁর শাসন উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং বাংলার কিছু অংশে বিস্তৃত ছিল।
২. রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি
- চন্দ্রগুপ্ত-I লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করেন।
- এই বিবাহের মাধ্যমে গঙ্গা উপত্যকার ওপর তাঁর প্রাধান্য নিশ্চিত হয়।
- এটি রাজনীতিতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল, কারণ লিচ্ছবি বংশ তখন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল।
৩. সিংহাসন ও উত্তরাধিকার নিশ্চিতকরণ
- মৃত্যুর আগে তিনি পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন।
- এই ব্যবস্থা গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজবংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হয়।
৪. অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার
- চন্দ্রগুপ্ত-I মুদ্রা চালু ও প্রকাশ করেন।
- প্রশাসনিক শক্তি ও কর ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার মাধ্যমে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।
- তিনি রাজ্যকে স্থিতিশীলভাবে পরিচালনার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সূচনা করেন।
৫. সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সম্প্রসারণ
- চন্দ্রগুপ্ত-I উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেন।
- গঙ্গা উপত্যকা, বিহার এবং বাংলার কিছু অংশে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে সংখ্যালঘু সামন্তদের অধীনে রেখে স্থিতিশীলতা আনে।
৬. সাংস্কৃতিক সমর্থন
- যদিও চন্দ্রগুপ্ত-I সময়কাল সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি ব্যয়িত, তবু তিনি সংস্কৃতি ও ধর্মে সহনশীল ছিলেন।
- তাঁর শাসনকালে প্রাথমিকভাবে হিন্দু ধর্ম ও সামান্য বৌদ্ধ ধর্ম সমর্থিত হতো।
সমুদ্রগুপ্ত (Samudragupta) – নেপোলিয়ন অফ ইন্ডিয়া
রাজত্বকাল: ৩৩৫ – ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ
গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসেবে সমুদ্রগুপ্তের নাম সুপরিচিত। তাঁর সামরিক প্রতিভা, শৌর্য-বীর্য ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইতিহাসবিদরা তাঁকে “ভারতের নেপোলিয়ন” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
সিংহাসন আরোহণ
ইতিহাসবিদ ড. রোমিলা থাপারের মতে, তিনি আনুমানিক ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয় অভিযান
আলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে তাঁর সামরিক বিজয়ের বর্ণনা পাওয়া যায়।
তিনি তিন ধরনের শাসককে পরাজিত করেছিলেন:
- আর্যাবর্তের রাজারা – সরাসরি দখল
- দক্ষিণাত্যের রাজারা – জয় করে পুনরায় স্বাধীনতা প্রদান
- আত্মসমর্পণকারী রাজারা – করদ রাজ্য
সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব (Achievements of Samudragupta)
১. সামরিক কৃতিত্ব
- সমুদ্রগুপ্তকে প্রায়ই “ভারতের নেপোলিয়ন” বলা হয়।
- তিনি দিগ্বিজয় অভিযান চালিয়ে ভারতকে এককেন্দ্রিক শক্তির আওতায় এনেছেন।
- আলাহাবাদ স্তম্ভলিপি অনুযায়ী তিনি তিন ধরনের শাসককে পরাজিত করেছিলেন:
- সরাসরি অধীনে আনা রাজারা
- আত্মসমর্পণকারী রাজারা
- জয় করার পর স্বাধীনতা দেওয়া দক্ষিণাত্য রাজারা
- তার সেনা ও কৌশল দক্ষতার কারণে হিন্দুস্তানের বৃহত্তর অঞ্চল শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর নিয়ন্ত্রণে আসে।
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
- সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
- আঞ্চলিক রাজাদের আত্মসমর্পণ এবং তাদের প্রতি ন্যায্য শাসন দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. অর্থনীতি ও মুদ্রা সংস্কার
- সমুদ্রগুপ্ত স্বর্ণ ও রূপা মুদ্রা প্রচলন করেন, যা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক শক্তিকে প্রতিফলিত করে।
- বাণিজ্য এবং কৃষির উন্নয়নে গুরুত্ব দেন।
- রাজস্ব সংগ্রহ ও প্রশাসন সুদৃঢ় করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনে।
৪. সংস্কৃতি ও ধর্মে পৃষ্ঠপোষকতা
- সমুদ্রগুপ্ত সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
- নিজ সময়কার বীণাবাদী সম্রাট হিসেবে পরিচিত।
- হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিলেন।
- শিক্ষাবিদ, কবি ও শিল্পীদের সমর্থন দিয়ে ভারতীয় সভ্যতা সমৃদ্ধ করেন।
৫. প্রশাসনিক দক্ষতা
- সমুদ্রগুপ্ত প্রাদেশিক শাসকগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ় করেন।
- প্রশাসনিক দক্ষতা এবং শাসনব্যবস্থার মান উন্নয়নের মাধ্যমে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী রাখেন।
৬. আন্তর্জাতিক কূটনীতি
- সমুদ্রগুপ্ত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী শ্রীলঙ্কার রাজাকে কূটনৈতিক সহায়তা দেন।
- ভারতের বহির্বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রসার ঘটান।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (Chandragupta II Vikramaditya) – স্বর্ণযুগের নির্মাতা
রাজত্বকাল: ৩৮০ – ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ:
সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত যুগের সর্বাধিক গৌরবময় শাসক। তাঁর রাজত্বকালে ভারত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক বিকাশের শীর্ষে পৌঁছায়।
রামগুপ্তের কাহিনি:
‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম্’ নাটক অনুযায়ী—
- রামগুপ্ত প্রথমে সিংহাসনে বসেন
- শক রাজার কাছে পরাজিত হয়ে স্ত্রী ধ্রুবদেবীকে সমর্পণ করতে বাধ্য হন
- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সেই শক রাজাকে হত্যা করেন
- পরে রামগুপ্তকে হত্যা করে ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করেন
অনেক ইতিহাসবিদ এই কাহিনি সত্য বলে মনে করেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব (Achievements of Chandragupta II Vikramaditya):
১. রাজনীতি ও সামরিক কৃতিত্ব
- সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত যুগের অন্যতম শক্তিশালী শাসক।
- তাঁর সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য সর্বাধিক সম্প্রসারিত হয়, বিশেষ করে পশ্চিম ভারতের শক রাজাদের পরাজয় এবং তাদের অঞ্চল দখল করা।
- তিনি রাজ্যকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও এককেন্দ্রিক শাসনের আওতায় রাখেন।
- রামগুপ্ত ও শক রাজা সম্পর্কিত কাহিনির মাধ্যমে জানা যায় যে তিনি রাজ্যরক্ষা ও ক্ষমতার শাসন পুনঃস্থাপন করেছেন।
২. অর্থনীতি ও বাণিজ্য উন্নয়ন
- গুপ্ত সাম্রাজ্যের বাণিজ্য ও অর্থনীতি সমৃদ্ধ ছিল।
- দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভারতের বন্দরগুলি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়।
- তিনি মুদ্রা প্রচলন চালু রাখেন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যকে সমৃদ্ধ করেন।
৩. সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চা
- চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় সমৃদ্ধ সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
- তাঁর রাজত্বকালে নবরত্ন সভা (Nine Jewels) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে কাব্যজ্ঞ ও শিক্ষাবিদরা ছিলেন।
- কালীদাস, বরাহমিহির, আমরসিংহ প্রমুখ গুপ্ত সভ্যতার এই নবরত্নে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
- সাহিত্যে সংস্কৃতকে সমৃদ্ধ ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করেছেন।
৪. ধর্ম ও সহিষ্ণুতা
- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন।
- বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু ধর্মকে সমানভাবে সমর্থন করেছিলেন।
- ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কারণে সমাজে শান্তি ও সমন্বয় বজায় থাকে।
৫. প্রশাসনিক সংস্কার
- রাজ্য পরিচালনায় কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
- রাজ্যের সীমানা রক্ষা ও প্রাদেশিক শাসকদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেন।
- কর ব্যবস্থার সুশৃঙ্খল বাস্তবায়ন এবং নিয়মিত রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।
৬. বিজ্ঞান ও গণিতের উন্নয়ন
- তাঁর রাজত্বকালে ভারতীয় গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রচলিত ও সমৃদ্ধ হয়।
- মন্দির, স্থাপত্য ও মুদ্রা শিল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার স্পষ্ট হয়।
কুমারগুপ্ত (Kumaragupta I):
রাজত্বকাল: ৪১৫ – ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর কুমারগুপ্ত গদী লাভ করেন। তিনি সাম্রাজ্যের সীমানা অটুট রাখেন এবং অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন।
কুমারগুপ্তের কৃতিত্ব
- অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন
- বহির্বাণিজ্যের উন্নতি
- মুদ্রা প্রচলন অব্যাহত
- হূণ আক্রমণ প্রতিহত—যুবরাজ স্কন্দগুপ্তের নেতৃত্বে
স্কন্দগুপ্ত (Skandagupta) – শেষ শক্তিশালী সম্রাট
রাজত্বকাল: ৪৫৫ – ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ
স্কন্দগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ প্রভাবশালী সম্রাট।
তিনি কঠিন সময়ে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন, বিশেষ করে হূণদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে তিনি “ভারতের রক্ষাকারী” উপাধিতে ভূষিত হন (রমেশচন্দ্র মজুমদার)।
স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্ব (Achievements of Skandagupta)
১. হূণ আক্রমণ প্রতিহত
- স্কন্দগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ শক্তিশালী সম্রাট।
- হূণদের আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন।
- রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁকে “ভারতের রক্ষাকারী” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
- তাঁর নেতৃত্বে হূণদের সামরিক আগ্রাসন ব্যর্থ হয় এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা পায়।
২. প্রশাসনিক দক্ষতা
- রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে স্কন্দগুপ্ত কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেন।
- প্রাদেশিক শাসকদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে কেন্দ্রীয় শাসন শক্তিশালী রাখেন।
- রাজ্যের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কার প্রবর্তন করেন।
৩. স্থাপত্য ও জলবিন্যাস
- জুনাগড় লিপি থেকে জানা যায় তিনি সৌরাষ্ট্রে সুদর্শন হ্রদ সংস্কার করেছেন।
- হ্রদ সংস্কারের মাধ্যমে কৃষি ও পানীয় জল সরবরাহ উন্নত করা হয়।
- এটি স্থানীয় জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
৪. প্রজাবৎসল শাসন
- স্কন্দগুপ্ত ছিলেন প্রজাবৎসল ও ন্যায়পরায়ণ শাসক।
- জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সুশাসনের কারণে তিনি জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হন।
৫. সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষা
- হূণ আক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমান্ত অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেন।
- তাঁর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য দুর্বল হওয়া শুরু হলেও স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে সাম্রাজ্য সর্বাধিক সংরক্ষিত ছিল।
তাঁর মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধীরে ধীরে পতন শুরু হয়।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ:
১. হূণদের ধারাবাহিক আক্রমণ
- ৫ম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে হুনদের আগ্রাসন গুপ্ত সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
- স্কন্দগুপ্ত যদিও হুন আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন, তবে পরবর্তী শাসকগণ হুনদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন।
- ফলে সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং সীমানা রক্ষা করতে না পারার কারণে আঞ্চলিক শক্তিরা স্বাধীন হয়ে যায়।
২. দুর্বল পরবর্তী শাসকগণ
- স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর রাজত্বে আসা সম্রাটরা শক্তিশালী নেতৃত্ব দিতে পারেননি।
- অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াই সাম্রাজ্যকে ভেঙে দেয়।
৩. প্রশাসনিক দুর্বলতা
- বৃহৎ সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োজন।
- গুপ্তরা অল্প অঞ্চলে শক্তিশালী হলেও, সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ায় কেন্দ্রীয় শাসনের ক্ষমতা কমে যায়।
- প্রাদেশিক শাসকরা আত্মনির্ভর হয়ে কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে বিদ্রোহ করতে শুরু করেন।
৪. অর্থনৈতিক সংকট
- বহির্বাণিজ্য ও কর ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় রাজস্ব কমে যায়।
- হূণ আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়।
- মুদ্রা এবং কর ব্যবস্থার অবনতি সাম্রাজ্যকে আরও দুর্বল করে।
৫. আঞ্চলিক শক্তির উদয়
- প্রাদেশিক শাসক এবং আঞ্চলিক রাজারা স্বতন্ত্র শক্তি তৈরি করতে থাকেন।
- কেন্দ্রীয় শাসনের ওপর আস্থা হ্রাস পায়, ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে যায়।
৬. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণে পরিবর্তন
- সমাজে বৈষম্য, হ্রাসপ্রাপ্ত জনসংখ্যা এবং কৃষি উৎপাদনে সমস্যা সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বকে প্রভাবিত করে।
- রাজপথ, বানিজ্য রুট ও শহরের অবনতি সাম্রাজ্যকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে।
উপসংহার:
গুপ্ত সাম্রাজ্য শুধু রাজনৈতিক ঐক্যই স্থাপন করেনি—বরং ভারতীয় সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ও অর্থনীতিকে শুরু করে উন্নতির একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কাল গুপ্ত যুগকে ভারতের স্বর্ণযুগ হিসেবে মর্যাদা এনে দিয়েছে। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে গেলেও ভারতীয় সভ্যতায় গুপ্ত যুগের অবদান আজও অমলিন।



Post Comment